ধপ করে কিছু পড়ে যাওয়ার মতো শব্দটা বাবরি মসজিদের মধ্যযুগীয় অঞ্চলগুলোর মধ্য দিয়ে প্রতিধ্বনিত হয়েছিল শক্তিশালী ড্রামের আওয়াজের মতো। সেই শব্দে গভীর ঘুম থেকে ঝাঁকুনি খেলেন মুহাম্মদ ইসমাঈল, মসজিদের মুয়াজ্জিন। তিনি উঠে বসেন বিভ্রান্ত এবং ভীত হয়ে। যেহেতু গত দুসপ্তাহ ধরে বাইরের ঘটনাগুলোর সময় মসজিদটি খুব একটা ভরসাজনক অবস্থায় ছিল না। কয়েক মুহুর্তের জন্য অপেক্ষা করে মসজিদের অন্ধকার কোণে স্থির দাঁড়িয়ে থাকলেন, এমনভাবে ছায়াগুলোর গতিবিধি বোঝার চেষ্টা করলেন যেভাবে একটি শিশু জিগস পাজলের বাক্স—সামনের চিত্রের দিকে তাকায় এবং টুকরোগুলো এক সাথে যোগ করার চেষ্টা করে।
মসজিদের ওপর এত কালো মেঘের ঘনঘটা আগে কখনো দেখেননি তিনি। এমনকি ১৯৩৪ সালেও তিনি এতটা ভীতবোধ করেননি, যখন মসজিদটি আক্রমণ করা হয়েছিল এবং এর গম্বুজগুলো মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিল, এমনকি তাদের মধ্যে একটি বড় গর্তও তৈরি করেছিল। পরে অবশ্য সরকার মসজিদটি পুনঃনির্মাণ ও সংস্কার করে দিয়েছিল৷ সেসময় কোরবানী-ঈদ উপলক্ষে অযোধ্যার নিকটস্থ গ্রাম শাহজাহানপুরে গরু জবাইয়ের গুজবে উন্মত্ত জনতা ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছিল৷ এবার অনুপ্রবেশকারীরা সংখ্যায় তেমন বেশি না হলেও পনেরো বছর আগের ভিড়ের চেয়ে অনেক বেশি অশুভ দেখাচ্ছিল।
মুয়াজ্জিন ছিলেন খাটো, স্থূলকায় এবং শ্যামবর্ণের, তার পরনে ছিল স্বাভাবিক লম্বা কুর্তা পরা এবং একটি লুঙ্গি। সীমালঙ্ঘনকারীরা যখন মসজিদের দিকে হেঁটে এগিয়ে যাচ্ছিল মুয়াজ্জিন তখন অন্ধকার থেকে লাফিয়ে বেরিয়ে এলেন। প্রতিপক্ষরা তার উপস্থিতি টের পাওয়ার আগেই, তিনি সরাসরি অভিরাম দাসের দিকে ছুটে যান—সেই বৈরাগী যিনি হাতে মূর্তিটি ধরেছিলেন এবং অনুপ্রবেশকারীদের দলকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। তিনি অভিরাম দাসকে পেছন থেকে চেপে ধরে প্রায় তার কাছ থেকে মূর্তি ছিনিয়ে নিয়েছিলেন। কিন্তু সাধু দ্রুতই নিজেকে মুক্ত করে নিয়েছিলেন এবং তার মিত্রদের সাথে মিলে একত্রে প্রচণ্ডভাবে প্রতিশোধ নিয়েছিলেন। প্রবল মার যেন মুহুর্মুহু বর্ষণ হতে শুরু করেছিল মুয়াজ্জিনের ওপর৷ দ্রুতই মুয়াজ্জিন বুঝতে পেরেছিলেন যে এই লোকদের সাথে তার কোনো তুলনা চলে না এবং তিনি একা তাদের থামাতে পারবেন না।
মুহম্মদ ইসমাঈল তখন অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিলেন যেমনটি তিনি সামনে এসেছিলেন আকস্মিকভাবে। নিঃশব্দে তিনি বাইরের উঠানে পৌঁছাতে সক্ষম হলেন। এরপর তিনি দৌড়াতে শুরু করলেন। তিনি মসজিদ থেকে ছুটে বেরিয়ে গেলেন এবং কোথায় যাচ্ছেন সে চিন্তা না করে দৌড়াতে থাকলেন। তিনি হোঁচট খেয়েছিলেন এবং আরও বেশি আঘাত পাওয়া সত্ত্বেও আঘাতের ক্ষতগুলোর মধ্য দিয়ে যে ব্যথা হচ্ছিল তা অনুভব করতে অক্ষম ছিলেন। এরপরই, তিনি রক্তে এতটাই ভিজে যাচ্ছিলেন যে তার প্রতিটি পদক্ষেপে ফোঁটাফোঁটা রক্ত পড়ছিল। তিনি অতীত ছাড়া অন্যকিছু ভাবতেও হতবাক হয়ে গেলেন, আর স্বাভাবিকভাবেই বুঝে উঠতে পারছিলেন না— এখন কী করবেন। কীভাবে মসজিদ বাঁচাতে হবে, কোথায় দৌড়ে যাবেন তিনি। একটা সময় ছিল যখন তিনি মনে করতেন যে বৈরাগীরা যারা কবরস্থান দখল করার চেষ্টা করেছিল এবং তারপরে নবহপাঠ ও কীর্তনে অংশ নিয়েছিল তারা তাদের দৃষ্টিভঙ্গি ইতিহাসের একটি করুণ ভুল পাঠের ওপর ভিত্তি করে তৈরি করেছিল—একদিন তাদের ভেতর শুভবোধের উদয় হবে, আর হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে যে অবিশ্বাস দেশভাগের সময় বেড়ে গিয়েছিল—তা সেরে উঠবে। ২২ নভেম্বর তারিখে নবহপাঠ শুরু হওয়ার পর থেকে বাবরি মসজিদের বাইরে পুরো নির্মাণের সময় তিনি এটাই ভেবেছিলেন। আর সে কারণেই তিনি সত্যিই এসব গুজব বিশ্বাস করেননি যে রাম চবুতরা ও এর আশপাশে পুরো অনুষ্ঠানের আসল উদ্দেশ্য ছিল মসজিদ দখল করা।
রাম চবুতরার পুরোহিতদের সাথে মুহাম্মদ ইসমাইলের সব সময়ই সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। ইতিহাস তাদের মধ্যে যে বিদ্বেষ সৃষ্টি করে রেখেছিল তা তাদের প্রতিদিনের মিথস্ক্রিয়া এবং তারা একে অপরের দিকে যে পারস্পরিক সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল তার পথে কখনো বাঁধা হয়ে আসেনি। ভাস্কর দাস—যিনি তখন কার দিনে রাম চবুতরার ছোট মন্দিরের একজন অনুজ পুরোহিত ছিলেন এবং যিনি পরে নির্মোহী আখড়ার মহন্ত হন—তিনিও বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
“১৯৪৯ সালের ২২ ডিসেম্বরের আগে আমার গুরু মহন্ত বলদেব দাস আমাকে চবুতরায় দায়িত্ব দিয়েছিলেন। আমি সেখানে আমার প্রয়োজনীয় জামাকাপড় এবং বাসনপত্র রাখতাম। রাতেও বিকেলে আমি বাবরি মসজিদের ভেতরে ঘুমাতাম। মুয়াজ্জিন আমাকে নামাজের সময় আমার জিনিসপত্র সরিয়ে ফেলতে বলতেন, আর বাকি সময় মসজিদই থাকত আমাদের বাড়ি।” [১]
যেখানে চবুতরা পুরোহিতদের ভরণপোষণের জন্য যথেষ্ট নৈবেদ্য পেতেন, সেখানে মুয়াজ্জিন সাধারণত সর্বদা সঙ্কটের মুখোমুখি হতেন। কারণ, তার রক্ষণাবেক্ষণের জন্য তার সম্প্রদায়ের অবদান ছিল অত্যন্ত অনিয়মিত। প্রায়শই, বৈরাগীরা, বিশেষ করে চবুতরার পুরোহিত মুয়াজ্জিনকে খাওয়াতেন। [২] বিষয়টি এমন ছিল যে একটি ধর্মীয় কমপ্লেক্সের ভিতরে বসবাস করছে গোটা একটি সম্প্রদায়ের৷ উভয়পক্ষের সাম্প্রদায়িকরা উভয়ের মধ্যে পার্থক্য করতেন, কিন্তু মুয়াজ্জিনের জন্য তারা সবাই ছিলেন এক।
কিন্তু বিষয়টি তেমন ছিল না যখন ঐ রাতে বৈরাগীরা মসজিদে ঢুকেছিল। তিনি তখন এমনটা ভাবতেই বাধ্য হলেন যে, তাদের ওপর তিনি যে আস্থা রেখেছিলেন, সেটা তার মূর্খ অনুমান ছাড়া আর কিছুই ছিল না। এটা আসলে সেখানে ছিল না। এক মুহূর্তের মধ্যেই বদান্যতার বৈরাগীদের ধূম্রজাল অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল। মনে হলো যেন সেই শীতাবৃত রাতের মধ্যভাগে মুয়াজ্জিন একটা জাগরণ অনুভব করেছিলেন। তার ভাবনার নতুন, সংশোধিত উপায় তাকে এটা জানান দিয়েছিল যে রামলল্লার মূর্তি ধারণ করে অন্ধকারের আড়ালে যারা বাবরি মসজিদে প্রবেশ করেছিল তাদের ইতিহাস নিয়ে দূরদর্শিতা ভুল ছিল না। তারা যা করে ফেলেছিল তা ছিল প্রথমস্তরের অপরাধ এবং তারা যা করার চেষ্টা করে যাচ্ছিল তা ছিল এক কথায় সর্বনাশা। প্রকৃতপক্ষে, এই ব্যক্তিদের সে সর্ম্পকে কোনো ধরনের দূরদর্শিতা ছিল না।
শক্তিক্ষয় হতে থাকা সত্ত্বেও, মুহাম্মদ ইসমাঈল দুই ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে নিজেকে টেনে টেনে এগিয়ে যাচ্ছিলেন এবং অবশেষে গিয়ে পাহাড়গঞ্জের ঘোসিয়ানা গ্রামে থামলেন৷ ঘোসি মুসলমানদের গ্রামের নাম ঘোসিয়ানা। ঘোসি মুসলমান—ফৈজাবাদের উপকণ্ঠে ঐতিহ্যবাহী গবাদি পশুপালকদের একটি মুসলিম উপজাতি। আসলে এই গ্রামের বাসিন্দারাই প্রথম বাবরি মসজিদের পবিত্রতা লঙ্ঘনের সত্যটি সম্পর্কে জাগ্রত হন যখন ১৯৪৯ সালের ২৩ ডিসেম্বর রাত ২টার দিকে ক্ষিপ্ত ‘ইসমাঈল সাহেব’ এসে তাদের দুয়ারে কড়া নেড়েছিলেন। আবদুর রহিম, যিনি মসজিদটি অপবিত্র হওয়ার আগে একজন নিয়মিত মুসল্লী ছিলেন—তার ভাষ্যমতে, তারা হয়তো ইসমাঈল সাহেবকে হত্যা করত। কিন্তু তিনি কোনোভাবে বাবরি মসজিদ থেকে পালিয়ে আসতে সক্ষম হন। তিনি রাত ২টার দিকে আমাদের গ্রামে পৌঁছান। তিনি গুরুতরভাবে আহত হয়েছিলেন এবং এই ঘটনাপ্রবাহের কারণে একেবারে ভীত ছিলেন। কয়েকজন গ্রামবাসী উঠে তাকে খাবার ও গরম কাপড় দিলেন। পরে তিনি মুয়াজ্জিন হিসেবে কাজ শুরু করেন গ্রামের মসজিদ এবং ১৯৮০-এর দশকের গোড়ার দিকে তার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত মসজিদ পরিষ্কার করা এবং দিনে পাঁচবার নামাজের জন্য আযান দেওয়ার দায়িত্ব আন্তরিকভাবে পালন করেছিলেন। [৩]
তথ্যসূত্র:
১. মহন্ত ভাস্কর দাসের সাক্ষাৎকার।
২. ফারুক আহমদের সাক্ষাৎকার। ৪ অক্টোবর ২০১০ তারিখে অযোধ্যায় তিনি নিয়মিত দর্শনার্থী ছিলেন বাবরি মসজিদ হিন্দুদের দখলের আগে।
৩. ফৈজাবাদের পাহাড়গঞ্জ ঘোসিয়ানা গ্রামে ৫ অক্টোবর ২০১০-এ (১৯৪৯ সালে প্রায় ত্রিশ বছর বয়সী) আবদুর রহিমের সাক্ষাৎকার।
বই: অযোধ্যার কালোরাত
এ সংক্রান্ত দুটো বই অর্ডার অর্ডার করতে ক্লিক করুন
Book: অযোধ্যার কালোরাত