Your Cart

গুয়ান্তানামোতে নির্যাতনের গল্প

গুয়ান্তানামোতে আট মাস কাটিয়ে দেওয়ার পর আমি বুঝতে পারলাম যে আমাকে আইনজীবী দেওয়ার যে প্রতিশ্রুতি আমেরিকানরা শুরুতে দিয়েছিল, সেটা ছিল স্রেফ ফাঁপা একটা বুলি। নরকের মধ্যে দিন কাটাচ্ছিলাম আমি আর এর পেছনে ছিল জর্জ ডব্লিউ বুশের অনুমোদন।

মনে হচ্ছিল আমার এই গুয়ান্তানামোর জীবন যেন চিরকাল ধরে চলতেই থাকবে। আমি আমার স্টিলের সেলে বসেই আছি আর দেখে যাচ্ছি একের পর এক তরুণ গার্ড আর ইন্টারোগেটররা আসছে আর যাচ্ছে। মার্কিন মিলিটারি সিস্টেমের ক্ষমতা আর কঠোরতা উপলব্ধি করতে শুরু করলাম। কি অনায়াসে যে এই সিস্টেম গ্রাস করে নিতে পারে একজন মানুষকে, সেটাও জানা হয়ে গেল আমার। এই ক্ষেত্রে সে মানুষটা ছিলাম আমি।

একদিন গার্ডের কথায় বেশ চমকে গেলাম। সে আমাকে জানাল আমি নাকি ‘রিজার্ভেশন’-এ যাচ্ছি। এর অর্থ আমাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নিয়ে যাওয়া হবে, কিন্তু সেটা ক্যাম্প ইকোতে নয়। ক্যাম্প ডেল্টার কাছাকাছি কোথাও আমি আছি, এটা আমার জন্য প্রথমবার। ক্যাম্প ডেল্টা হচ্ছে গুয়ান্তানামোর প্রধান কারাগার এবং এ জন্য বেশ কৌতূহলী হয়ে উঠেছিলাম আমি। আর বরাবরের মতোই আশা করছিলাম ইতিবাচক কিছু একটা ঘটার।

মিলিটারি পুলিশ আমাকে থ্রি পিস স্যুট পরিয়ে দিলো। ছোটোখাটো একটা মেডিকেল ভ্যানের পেছনে নিয়ে যাওয়া হলো আমাকে। সেখানে একজন গার্ডের পাশে আমাকে রীতিমতো ঠেসে বসানো হলো। মনে হলো ইস্পাতের কোনো চুল্লির ভেতরে ঢুকে গেছি। একটু যে পানি খাবো সে সুযোগও নেই। কোনো খাবার পানি সেখানে রাখা হয়নি। ক্যাম্প ইকো থেকে ক্যাম্প ডেল্টার দূরত্ব আধা মাইল বা এরকম কিছু একটা হবে। গার্ডদের কাছ থেকে শুনে আর রিক্রিয়েশন ইয়ার্ডের খাঁচায় ওঠার সময় চট করে এক নজর দেখে নিয়ে হিসাবটা করে ফেলেছিলাম। দেখতে পেলাম একটা বন্ধ এলাকার দিকে সাপের মতো আঁকাবাঁকা একটা রাস্তা চলে গেছে। দূরে কোথাও আযানের ধ্বনিও শুনতে পেলাম, কিন্তু আধামাইল রাস্তার এই জার্নিতে লেগে গেল এক ঘণ্টার বেশি। এই সময়ে গাড়ি কখনো থামল, কখনো আবার গড়িয়ে গড়িয়ে এগোলো।

মনে হলো শরীর থেকে সব পানি বেরিয়ে যাচ্ছে। পাশে বসে থাকা সৈনিকটাকে বললাম, “এটা একেবারে বাজে ব্যাপার। এই রিজার্ভেশনে যেতে এত সময় লাগছে কেন? গাড়িতে এটা তো স্রেফ কয়েক মিনিটের রাস্তা হওয়ার কথা।” সে জবাব দিলো না বটে, কিন্তু গরমে সে-ও যে বেকায়দায় আছে সেটা বেশ বোঝা গেল।
সকালে কিছু খাওয়াও হয়নি। গার্ডরা হুড়মুড়িয়ে সেলের মধ্যে ঢুকে পড়েই বলে দিলো, “রেডি হয়ে যাও, তোমাকে যেতে হবে, কেউ একজন তোমাকে দেখতে চায়।”
ঘাম বেয়ে পড়ছিল মুখ দিয়ে। শেকলের ভেতর থেকে এটা অনুভব করছিলাম। সহ্য করতে পারলাম না আর। বলে ফেললাম, “প্লিজ! আমার খুব, খুব, খুব পানির দরকার!”

“আমি ভেতর থেকে দরজা খুলতে পারব না। জায়গামতো পৌঁছানোর আগপর্যন্ত তারা দরজা খুলবে না।” সে দরজায় আঘাত করতে পারত অথবা রেডিওটাও ব্যবহার করতে পারত। কিন্তু এসব না করে অপেক্ষা করার সিদ্ধান্তই নিল সে। এই যে মিলিটারি কঠোরতা, সাধারণ মানবিক বোধ শক্তি দিয়ে একটা পরিস্থিতি উপলব্ধি করতে পারার অক্ষমতা, সাবলীলতার মারাত্মক অভাব—এই সবকিছু একসময় আমাকে বিধ্বস্ত করে ফেললো। যদিও সারাক্ষণ ধরে আমি চেষ্টা করে যাচ্ছিলাম নিজের ফুঁসে ওঠা রাগকে নিয়ন্ত্রণ করার।

হঠাৎ করে গাড়ির ভেতরেই বমি করে ফেললাম। গাড়িটা যেহেতু একটা মেডিক্যাল ভ্যান ছিল, তাই একটা বালতি ছিল এটাতে। গার্ড টান দিয়ে আমার কাছে বালতিটা নিয়ে এলো। শেষপর্যন্ত জোরে জোরে দরজায় ধাক্কা দিতে লাগল সে। থেমে গেল ট্রাক। আমাকে পানি দেওয়া হলো, এই অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে সাহায্য করল ওরা।
শান্ত থাকার চেষ্টা করে যাচ্ছিলাম। “অসম্ভব ব্যাপারস্যাপার! তোমরা কি জানো কতক্ষণ ধরে আমি এ গাড়ির পেছনে পড়ে আছি?”

“তো কী হয়েছে? তোমার সাথে এই সৈনিকও পেছনে ছিল।”

প্রচণ্ড রেগে গেলাম। “তাকেও কি এই ফালতু শিকলে বেঁধে রাখা হয়েছে? বলো, হয়েছে?”

আমাকে একটা ঘরে নিয়ে যাওয়া হলো। মেঝেতে একটা ধাতব আংটার সাথে আমার শিকলটা লাগিয়ে দেওয়া হলো। একা একটা চেয়ারে বসে রইলাম। কিন্তু খুব অস্বস্তি লাগছিল, পা নাড়াতে পারছিলাম না, এমনকি একটু টান করেও বসতে পারছিলাম না। শেষপর্যন্ত কিছু করতে না পেরে মেঝেতে শুয়ে পড়লাম। সেই একলা ঘরে সাত ঘণ্টার মতো সময় কেটেছে আমার। এই লম্বা সময়টায় একটা লোকও আসেনি, পেটে কোনো দানাপানিও পড়েনি।

অবশেষে সেই সারপ্রাইজ ভিসিটরের দেখা পাওয়া গেল। ফরেইন অফিস থেকে এসেছে মার্টিন, সাথে আরেকজন আমেরিকান। সম্ভবত একজন ইন্টারোগেটর। এরা আসার পর মেঝে থেকে উঠে বসলাম। তাদেরকে জানালাম সেদিন আসলে কী ঘটেছে।

আমাকে বাঁধনমুক্ত করতে বলল মার্টিন। কমপক্ষে এটুকু সে করেছিল। পায়ের বাঁধনটুকু ছাড়া বাকি সব খুলে দেওয়া হলো। দেখে মনে হলো এটা একটা ওয়েলফেয়ার ভিজিট। “কোনো অভিযোগ আছে?”

নেই মানে? অবশ্যই আছে। অনেক অভিযোগ আছে আমার। প্রথমবারের মতো বন্দী হওয়ার পর আমাকে রাখা হয়েছিল কুকুরের ঘরে। চিঠিপত্র নিয়মিত পাঠানো যেত না। খাবার দাবার ছিল জঘন্য, বিনোদন ছিল স্রেফ একটা তামাশা, আর সবচেয়ে বাজে ব্যাপার যেটা, সেটা হচ্ছে আমি এখনও জানি না কী হতে যাচ্ছে, এবং আমার জন্য আইনজীবী হিসেবে যাদের থাকার কথা, তারা এখনও আসেইনি। সব খুলে বললাম আমি।

বেশ অবাস্তব একটা ব্যাপার। এই ইংরেজ এখানে বসে আছে এবং তাকে দেখে আমি অদ্ভুতভাবে খুশি হয়ে যাচ্ছি শুধু এই কারণে যে সে একজন ইংরেজ। সে আমার জন্য বাড়ি থেকে চিঠি, ফটো, ম্যাগাজিন এনে দেবে। কিন্তু আমরা বসে ছিলাম একটা ইন্টারোগেশন রুমে, টেবিলের দুই প্রান্তে, যেন কোনো ক্যাফেতে বসে সবাই মিলে আড্ডা দিচ্ছি।

এই বইটি আপনাকে গুয়ান্তানামো নিয়ে একটি স্বচ্ছ ধারণা দেবে।

বই সম্পর্কে বিস্তারিত কমেন্টে

Book: শত্রুযোদ্ধা