বলদাকে আমাদের আফগান উদ্বাস্তুদের দেখার সুযোগ মেলে। আরো একটি অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হই। অত্যন্ত তিক্ত সে অভিজ্ঞতা। বলদাকে আমরা উদ্বাস্তু শিবির পরিদর্শনে যাই। বছর বিশেকের একজন নারীর দিকে চোখ আটকে যায়। সে তার সন্তানদের মাঝে বসে ছিল। বসে বসে তিনি কাপড় ধুচ্ছিলেন। কর্দমাক্ত পানিতে। কোন সাবান ছিল না। এক হাতে কাপড় ধোয়া আরেক হাতে সন্তানকে বুকের দুধ খাওয়াচ্ছিলেন। তার পাশে তিন বা চার বছরের এক ছোট বালক দাঁড়িয়ে কাঁদছিল।
আমার কাছে মনে হয়েছে, এই দৃশ্যটিই আফগানিস্তানের চিত্র। আমি তার অবস্থা ভিডিও করার সিদ্ধান্ত নিলাম। আমি পৃথিবীকে জানাতে চাই এখানে কী পরিস্থিতি চলছে। দেখাতে চাই আমেরিকার যুদ্ধে আক্রান্ত মানুষদের অবস্থা কি রকম। আমেরিকার বোমা বর্ষণে কতটা বিধ্বস্ত হয়েছে আফগান জনপদ। অথচ মার্কিনিরা প্রচার করে বেড়াচ্ছে তারা বিশ্ব শান্তি, মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের সুরক্ষাদাতা।
আমি ভিডিও করা শুরু করলাম। সেখানে তার সামনে একটি পুড়ে যাওয়া সুটকেস ছিল। আমি তার চারপাশের ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা জিনিসগুলোরও ভিডিও করি। আমি তার পাশে আংশিক পুড়ে যাওয়া এক কপি কুরআনও দেখতে পাই। আমি যখন সে দৃশ্য আরো কাছ থেকে ধারণ করতে যাই দেখি তার উপর একটি লাল সুতা পেঁচানো বল রাখা। আমি কাপড়ের টুকরাটি একটু একপাশে রাখতে গিয়েছি ওমনিই সে মহিলা এক ছো মেরে মাটিতে ধপাস করে বসে পড়ে। যেন তাকে জ্বীনে ধরেছে। সে কান্না-চিৎকার করে বিলাপ করতে শুরু করে দিল। কিন্তু আমি বুঝতে পারছিলাম না কেন এমন করছে সে। আমি হতবুদ্ধ হয়ে গেলাম। দোভাষীকে জিজ্ঞেস করলাম, “কেন সে এত বিক্ষুদ্ধ হয়ে উঠল? আপনি তাকে সোজা করে ধরে রাখুন যাতে তার কাপড়-চোপর ঠিক থাকে।”
হঠাৎ তার মা দৌঁড়ে এলো। সে আমাকে একপাশে ঠেলে দিল। পশতু ভাষায় রাগতস্বরে আমাকে কী যেন বলল। দোভাষীকে জিজ্ঞেস করলাম। দোভাষী জানালো, আমি কেন লাল কাপড়ে বাধা গোলাকার বস্তুটি ধরেছি, কেন তার মেয়ে এভাবে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছে-সে জন্য তিনি চটেছেন।
মহিলাটি দোভাষীকে বলল, লাল বস্তুটিতে তার মেয়ের যুবক স্বামী, পিতা, ভাই এবং ভাইয়ের স্ত্রীর পোড়া লাশের ভষ্ম জমানো আছে। যুদ্ধবিমানের বোমা নিক্ষেপে তাদের গ্রামের প্রায় সবাই মারা যায় শুধু মেয়েটি তার দুই শিশু সন্তান আর মা বেঁেচ যায়। সবকিছু হাতছাড়া হয়ে গেছে শুধু আছে এই স্মৃতিটুকু। যা সে সব সময় তার সঙ্গে রাখে।
এই মহিলার চিত্র আর তার পরিবারের ঘটনাটি আমার হৃদয়ে গেঁথে যায়। বিশেষ করে তারা এমন লোক যারা জানে না তাদের সাথে কী ঘটছে। তারা জানত না কাবুল আফগানিস্তান নামক দেশের রাজধানী, তাদের একটি জাতীয়তা রয়েছে। তারা এটাও জানত না যে আমেরিকার সাথে তাদের ‘সন্ত্রাসবাদ’ ইস্যুতে যুদ্ধ চলছে।
যখন আমরা শুনতে পেলাম যে তালেবানদের পতন হয়েছে তখন পাকিস্তানে চলে আসি। ভিসা সংক্রান্ত কাজগুলো সমাধা করি। ইসলামাবাদে আসার পথ ধরি। সেখান থেকেই আমরা পরিকল্পনা করি এ যাত্রা এখানেই ইতি টানার। তখনো রামাদান চলছিল। পাকিস্তানে এসে আমরা অংশ নিই কাতারি রাষ্ট্রদূত আব্দুল্লাহ আবু ফালাহর ইফতারির দাওয়াতে।
ইফতারিতে যাই সহকর্মীরা মিলে। ইউসুফ আল সোমালি, ইঞ্জিনিয়ার ইবরাহীম, আহমেদ জায়দান এবং মিয়া বাইদুন ছিলেন আমার তখনকার সহকর্মী। আমরা সেখানে সৌদি অ্যাম্বাসির কর্মকর্তাদের সাথেও মিলিত হই। তাদেরকে পাকিস্তানি সীমান্তে আটক সৌদি নাগরিকদের সম্পর্কে বলি। এছাড়া আটক অন্যান্য আরবদের সম্পর্কেও বলি। তাদের মধ্যে অধিকাংশই ইয়ামেনি যারা বিভিন্ন কারণে সেখানে এসেছিল। আফগানিস্তানের অবস্থা বেগতিক দেখে পাকিস্তান সীমান্ত দিয়ে পালিয়ে যাবার চেষ্টা করছে নারী, শিশুসহ প্রায় শতাধিক পরিবার।
রাষ্ট্রদূত আবুল ফলাহ নিশ্চিত করেন যে এসব পরিবারের ব্যাপারে তিনি আগেও শুনেছেন। ইয়ামেনি রাষ্ট্রদূতের সাথে আলাপ করে তিনি দ্রুতই সর্বশেষ অবস্থা জানবেন এবং তার সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিবেন।
খাবার শেষে আমি হোটেলে ফিরে আসি। দোহায় ফিরে যাবার প্রস্তুতি নিই। রুমে আসার কিছুক্ষণের মধ্যেই রাষ্ট্রদূত আবুল ফলাহর ফোন। জানালেন, আল-জাজিরার ডিরেক্টর মুহাম্মদ জসিম আল আলী তার সাথে যোগাযোগ করে আমাকে পাকিস্তানে থেকে যেতে বলেছেন। আফগানিস্তানে যাবার ভিসা রিনিউ করা হবে। দোহা থেকে নতুন একজন সহকর্মী আসছেন। আব্দুল হক সাদ্দাহ। কান্দাহারে নতুন সরকারের নিউজ কভার করার জন্য।
Book: কয়েদী ৩৪৫