Your Cart
কয়েদী ৩৪৫ | গুয়ান্তানামোতে ছয় বছর

আফগানিস্তানে তালেবান ভেবে সাধারণ গ্রাম্য মানুষদের উপর আমেরিকান হামলা

আমি তাকে বললাম ঘটনা খুলে বলতে। তখন তিনি বললেন, আপনার কি মনে পড়ে আপনি যখন একজন লোকের সাক্ষাৎকার নিচ্ছিলেন তখন আপনার পাশে আরো কিছু লোক কাঁদছিল এবং আপনার সাথে কথা বলছিল?

“তারা বলছিল যে বিমানগুলো যখন গ্রামটিকে ঘিরে বোমা বর্ষণ করতে থাকে। তখন পাহাড়ের পাদদেশেও কিছু বসতি ছিল। সে বসতিগুলো এখন পাথর চাপা পড়েছে। গ্রামের সে লোকটি চাচ্ছিল কেউ একজন তাকে ধ্বংসস্তূপ থেকে তার পরিবারের লোকদের মৃতদেহ উত্তোলনে সাহায্য করুক। যাতে সে তাদের কবরস্থ করতে পারে।”

আমি ইমাম সাহেবকে কথা দিলাম পরদিন ফজরের নামাজের পর আমরা তার সাথে সেখানে যাব। হতভাগা লোকগুলোর শেষ পরিণতি কী হয়েছে দেখব। ছবি, ভিডিওসহ পুরো ঘটনার বিবরণ নিউজ করব। পরদিন ভোরে শপথমতো বেরিয়ে পরলাম। গ্রামের বন্ধুর পথ ধরে গাড়ি ছুটিয়ে দিলাম।

বেশ কিছুক্ষণ চলার পর গাড়ি থামিয়ে দিতে হলো। পায়ে হাঁটলাম প্রায় দুঘণ্টা। আমি গ্রাম্য উঁচুনিচু পথে হাঁটতে কিংবা হিমালয়ের হিমশীতল পথে গাড়ি চালাতে, হাঁটতে অভ্যস্ত না। আমি হাঁপাচ্ছিলাম তারপরও চেষ্টা করে যাচ্ছিলাম হাঁটতে, পায়ের জোর ধরে রাখতে।

গ্রামের কাছাকাছি আসতেই আমরা দেখি রকেটের কাটা, মার্কিন সেনাদের নিক্ষিপ্ত বোমায় সৃষ্ট হওয়া বিশাল গর্ত। গর্তটিতে একজন আস্ত মোটাসোটা মানুষ পুঁতে রাখা সম্ভব। বোমার আকার ও পরিমাণ দেখে আমি খুবই অবাক হলাম। কত কত টন বোমা তারা তৈরি করেছে, কত কত বিষ্ফোরক দ্রব্য লেগেছে এসব বানাতে। এই বিধ্বংসী বোমা তারা নিক্ষেপ করছে এসব গ্রাম্য মানুষের উপর!

আমরা হাঁটতে লাগলাম। গ্রামের যত ভেতরে যাচ্ছি ততই বড় বড় গর্ত দেখতে পাচ্ছি। এক পর্যায়ে গিয়ে দেখি শুধু পাথর। এক নজর চোখ বোলালেই আসলে বোঝা যায় যে এরা একরকম যাযাবর, গুহাবাসী। তাদের না আছে আমেরিকান সেনাদের মোকাবিলা করার শক্তি। না আছে তালেবানদের সাথে কোনো সম্পর্ক। এই প্রচÐ শীত কবলিত গ্রামে মানুষজন বোমার ভয়ে কাঁচা মাটিতে গর্ত করে থাকছে। উন্নত রুমহিটার সমৃদ্ধ বাড়ি বাদ দিয়ে। অনেকটা সৈনিকদের তাঁবুর মতো দেখতে সেসব ঘরবাড়ি। মার্কিন সেনারা এসব তাঁবুর মতো ঘরবাড়িকে তালেবানদের আস্তানা ভেবে বোম্বিং শুরু করে। নিরীহ মানুষগুলোকে মারতে শুরু করে।

কাবুল দখল করে আমেরিকানরা হেরাত দখলের জন্য এগোতে থাকে। বোম্বিং করে করে দখল করে নেয়। এরপর নজর দেয় কান্দাহারের দিকে। মার্কিন সেনারা কান্দাহার শহরে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে। প্রতিদিন অসংখ্য বেসামরিক মানুষ বোমায় ক্ষতবিক্ষত হয়ে মারা যায়। নারী, শিশু, বৃদ্ধরাই বেশি। শহরের প্রধান হাসপাতাল চাইনিজ হাসপাতাল তখন জনাকীর্ণ হয়ে উঠে।

সেই রাতে কান্দাহারে ঘুমাইনি। সারারাত বাইরে ছিলাম। কাজে ব্যস্ত ছিলাম। সকালে ফিরে এসেছি যদিও তখন বাইরে বোম্বিং হচ্ছিল। অবস্থা আরো খারাপ হলো যখন বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হলো। তখন শুধু ওই চাইনিজ হাসপাতাল ছাড়া আর কোথাও কোন আশ্রয় নেবার জায়গা নেই। তাই আমরা চ্যানেলে নিউজ পাঠাতে সেখানে গেলাম।

এই কঠিন মুহূর্তে বরকতের মাস রামাদান এসে পড়ে। কিন্তু সেবার রামাদানের প্রথম দিনেই আমরা তালেবানদের থেকে শহরের দখল ছেড়ে দেওয়ার ঘোষণা শুনি। আমাদের আফগান দোভাষী আমাদেরকে এলাকা ছেড়ে চলে যেতে বলে। তার সোজা কথা, “যদি তালেবান চলে যায় তবে শহরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়বে। আফগানীরা সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়বে।” আমি এখনো তার সে কথা স্মরণ করতে পারি। সে বলেছিল, “সামি, আপনি আফগানদের চেনেন না। যখন তারা নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষে লিপ্ত হয় তখন তারা কুকুরের চেয়েও নিকৃষ্ট হয়ে যায়। আমি আপনাকে একটিই পরামর্শ দেব-আপনি কান্দাহার ত্যাগ করুন।”

তাই আমরা রামাদানের প্রথম দিনেই কান্দাহার ত্যাগ করি। ইউসুফ আল সোমালি, ইঞ্জিনিয়ার ইবরাহীম নাসার এবং আমি। আমরা বলদাকের সীমান্ত অঞ্চলে যাই। সেখান থেকে চামান এবং কোয়েটাতে।

তালেবান নেতা মোল্লা মুহাম্মদ ওমরের বিশেষ সচিব তাইয়্যেব আগার বলদাকে একটি প্রেস কনফারেন্স করার ঘোষণা দেওয়ায় আমরা কোয়েটাতে কয়েকদিন থাকার সিদ্ধান্ত নিই। তাই অন্যান্য সাংবাদিকদের সাথে আমরাও সাংবাদিক সম্মেলন কভার করতে থেকে যাই।

Book: কয়েদী ৩৪৫