রানা আইয়ুব ২০১০ সালে তার গুজরাট ‘স্টিং অপারেশন’ (পরিচয় গোপন করে অপরাধ তদন্ত) শুরু করেছিলেন তেহেলকা ম্যাগাজিনের হয়েই। কিন্তু যখন তিনি ঘটনার সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন তথ্য হাতে পান তখন ‘চাপের কথা’ বলে সেসব প্রকাশে অস্বীকৃতি জানায় তেহেলকা কর্তৃপক্ষ।
এরপর আরো একাধিক সংবাদমাধ্যমেও তিনি তার অনুসন্ধানে প্রাপ্ত তথ্য প্রকাশের চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। এক পর্যায়ে সিদ্ধান্ত নেন রিপোর্ট আকারে যেহেতু প্রকাশ করতে কেউ রাজি হচ্ছে না, তাহলে বই হিসেবেই প্রকাশ করা যাক। অতপর এবার প্রকাশকদের পেছনে দৌড়ালেন কিছুদিন। নাহ ! ভারতের কোনো প্রকাশকই রাজি হয়নি রানার গুজরাটে মুসলিম গণহত্যা সংক্রান্ত অনুসন্ধানের ভিত্তিতে বই প্রকাশ করতে। কেউ উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের প্রিয় বিজেপি সরকারের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি’কে ঘাঁটাতে চাননি। শেষমেশ রানা আইয়ুব সিদ্ধান্ত নেন নিজেই বইটি প্রকাশ করবেন। এবং সে অনুযায়ী গত ২৫ মে, ২০১৬ তে দিল্লীতে এক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে প্রকাশ করেন।
লক্ষ্যণীয় হল, অনুসন্ধান নিয়ে রিপোর্ট এবং বই প্রকাশের ক্ষেত্রে এড়িয়ে চলা রানাকে এর পর থেকে প্রত্যাখ্যান করে চলেছে বিশ্বের সবচেয়ে ‘বড় গণতন্ত্র’ ভারতের মিডিয়া। প্রকাশের এক সপ্তাহের মধ্যে অ্যামাজনের বেস্টসেলার তালিকায় দ্বিতীয়তে থাকা বইটি নিয়ে সাংবাদিকরা একদমই চুপ। যদিও গুজরাট ফাইলসকে ‘দেশবিরোধী’ আখ্যা দিয়ে অনলাইনে ক্যাম্পেইন করে ঝড় তুলছে আরএসএস – সহ অন্যান্য হিন্দুত্ববাদী উগ্রপন্থীরা।
ভারতেরই একটি অনলাইন সংবাদমাধ্যম ২৮ মে, ২০১৬ তারিখে রানার প্রতি মিডিয়ার আচরণ নিয়ে একটি পর্যবেক্ষণমূলক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। “Why Media Blacked Out Rana Ayyub And Her Incisive Book On Gujarat Riots?“ শিরোনামের প্রতিবেদনটিতে তুলে ধরা হয়েছে কিভাবে প্রকাশনা অনুষ্ঠানটিকেও ‘বয়কট’ করেছেন সাংবাদিকরা। আবার অনেক সাংবাদিক তাতে উপস্থিত থাকলেও সংশ্লিষ্ট সংবাদমাধ্যম কোনো প্রতিবেদন ছাপায়নি রানা আইয়ুব বা তার অনুসন্ধান গুজরাট ফাইলস নিয়ে। মূলধারার সংবাদামাধ্যমগুলোর মধ্যে একমাত্র ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস সংবাদ ছাপিয়েছে রানাকে নিয়ে। ‘বুক রিভিউ’ হিসেবে ওয়্যার এবং লাইভমিন্ট নামক দুটি ওয়েবসাইটে প্রতিবেদন এসেছে। এর বাইরে হাতে গোনা তিন/চারটি ওয়েবসাইটে এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন পাওয়া যায়।
ভারতজুড়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার ইস্যু হওয়ার মতন এমন একটি ঘটনা নিয়ে মূলধারার মিডিয়া কেন নীরব – এমন প্রশ্নের জবাবে প্রকাশনা অনুষ্ঠানে হাজির হওয়া ইন্ডিয়া টুডে’র কনসাল্টিং এডিটর রাজদীপ সরদেশাই বলেন, ‘হয়তোবা কোনো মিডিয়া হাউজই এটা চায় না যে উপরের স্তরের রাজনীতিবিদদের সাথে তাদের যে সদ্ভাব আছে তা নষ্ট হয়ে যাক।’
মজার বিষয় হল শুধু ভারতে নয়, রানা আইয়ুবকে ‘ব্লাকআউট’ করার একই চিত্র ‘মোদিদপুষ্ট’ সরকারের অধীনে চলা বাংলাদেশের মিডিয়ায়ও বিদ্যমান! বইটি প্রকাশের এতো বছর পরও বাংলাদেশি কোনো পত্রিকায় একটি লাইনও ছাপা হয়নি দুঃসাহসী এই নারী সাংবাদিকের এতো বড় একটি কাজ নিয়ে। অথচ, ‘বলিউডের নারীদের’ নিয়ে গরম গরম প্রতিবেদন দিয়ে প্রতিদিন মুখর থাকে এখানকার পত্রিকা/টিভিগুলো। আবার বিশ্বজুড়ে ‘নারীর এগিয়ে যাওয়া’র নানান নজির এদেশীয় সংবাদমাধ্যমে প্রায়ই ছাপা হয় ‘অনুপ্রেরণা’ আকারে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হল, রানা আইয়ুবের এতো বড় দুঃসাহসিক কাজ থেকেও বাংলাদেশি নারী সাংবাদিকদের জন্য সামান্যতম ‘অনুপ্রেরণা’র ছিটেফুটোও গত তিন বছরে খুঁজে বের করতে পারলেন না এখানকার মিডিয়া কর্তারা!
সবকিছু বাদ দিলেও, একটি গণহত্যায় একজন ব্যক্তির দায়-দায়িত্ব প্রমাণিত হয় – এমন ডকুমেন্টেড তথ্য-উপাত্ত হাতে পেয়ে যখন কোনো গণমাধ্যম একেবারে ভাবলেশহীন হয়ে বসে থাকতে পারে তখন তাকে কী বলে অভিহিত করা যেতে পারে? ভীত? সেলফ সেন্সরড? বায়াস? নাহ, এসব শব্দ মিডিয়ার এমন ‘অসুস্থ্যকর’ নীরবতাকে ব্যাখ্যা করতে পারে না।
গুজরাট ফাইলস বইটি ক্রয় করতে অর্ডার করুন এই লিংক থেকে।